প্রাণের লালিত আবেগ, অনুভূতি,
ভাবনা যদি বাস্তব হতো;
তবে জীবনের বাস্তবতা কতো সুন্দর হতো!
[এই স্তবকে কবি জীবনের মৌলিক ইচ্ছা ও অনুভূতির কথা বলেছেন। তিনি বোঝাতে চেয়েছেন, মানুষের মনের গভীরে যে আবেগ, অনুভূতি এবং সুন্দর ভাবনাগুলো লুকিয়ে থাকে, সেগুলোর যদি বাস্তব রূপ দেওয়া যেত, তাহলে আমাদের জীবনের কঠিন বাস্তবতা অনেক বেশি সুন্দর ও সহজ হতো। এটি একধরনের আক্ষেপ, যেখানে কবি মনের স্বপ্ন আর বাস্তবতার মধ্যেকার ফারাক তুলে ধরেছেন।]
নীল আকাশের চাঁদনী রাতের
তারাগুলো যদি সাথী হতো;
তবে জীবনে সাথীহারা বেদনা নাহি হতো।
[এই অংশে কবি চাঁদনী রাতের তারাগুলোকে বন্ধু বা সাথী হিসেবে কল্পনা করেছেন। তিনি বোঝাতে চেয়েছেন, যদি প্রাকৃতিক সৌন্দর্য বা আকাশের তারাগুলো মানুষের একাকীত্ব দূর করতে পারত, তাহলে জীবনে সাথী হারানোর যে কষ্ট, সেই বেদনা আর থাকত না। এটি একাকীত্বের অনুভূতি এবং প্রকৃতিকে আশ্রয় করে দুঃখ ভোলার এক রোম্যান্টিক চিত্রায়ন।]
মানব মনের আবেগ, অনুভূতি
যদি বাস্তবতায় রূপান্তর হতো;
তবে জীবনে শোক-দুঃখের সমবেদনা নাহি হতো।
[প্রথম স্তবকের মতোই এই স্তবকটিও আবেগ ও বাস্তবতার মধ্যেকার সম্পর্ক নিয়ে লেখা। কবি বলতে চাইছেন, যদি মানুষের মনের গভীর আবেগগুলো বাস্তবে রূপ নিত, তাহলে জীবনের দুঃখ, শোক বা কষ্টগুলো আর অনুভূত হতো না। এখানে ‘শোক-দুঃখের সমবেদনা’ বলতে সেইসব অনুভূতিগুলোকে বোঝানো হয়েছে, যা আমরা কষ্ট পেলে অনুভব করি। অর্থাৎ, মনের ইচ্ছাপূরণ হলে জীবনে কোনো কষ্টই থাকত না।]
জীবনে প্রেম, বিরহ, বিচ্ছেদ যদি নাহি হতো;
তবে জীবন উপভোগের বাস্তবতা কতো সুখী সুন্দর হতো!
[এই স্তবকে কবি ভালোবাসার সম্পর্কগুলোর তিক্ত দিক—বিরহ আর বিচ্ছেদের কথা বলেছেন। তিনি মনে করেন, যদি জীবনে প্রেমজনিত কষ্ট, বিচ্ছেদ বা দূরত্ব না থাকত, তাহলে জীবনের আনন্দ উপভোগ করাটা আরও সহজ ও সুন্দর হতো। এটি প্রেমের কষ্টের প্রতি একধরনের হতাশা প্রকাশ করে।]
ভালোবাসার প্রাণের আবেগ, অনুপ্রেরণা
যদি প্রাণবন্ত হতো;
তবে জীবনে স্বর্গীয় ভালোবাসার
অনুভূতি মনোমুগ্ধকর হতো।
[এখানে ভালোবাসা থেকে আসা অনুপ্রেরণার কথা বলা হয়েছে। কবি মনে করেন, যদি ভালোবাসার আবেগগুলো সত্যিই জীবন্ত ও শক্তিশালী হতো, তাহলে সেই ভালোবাসার অনুভূতি এতটাই মনোমুগ্ধকর হতো যে তা স্বর্গের মতো এক স্বর্গীয় অনুভূতির জন্ম দিত। এটি ভালোবাসার এক আদর্শিক রূপ।]
প্রেমের রিক্ত বিরহ-বেদনার অনুভূতি
যদি গতিময় হতো;
তবে জীবনপ্রবাহের গতিস্রোত কতো সুন্দর হতো!
[এই স্তবকটি বেশ গভীর। ‘রিক্ত বিরহ-বেদনা’ হলো শূন্য বা অসহায় বোধ করা বিরহ-কষ্ট। কবি বলছেন, এই কষ্টগুলো যদি গতিশীল হতো, অর্থাৎ সময় যেমন বয়ে যায়, কষ্টও যদি সেভাবে দ্রুত চলে যেত, তাহলে জীবনের স্বাভাবিক গতি আরও সুন্দর হতো। এখানে কবি দুঃখের স্থবিরতার বদলে তার দ্রুত চলে যাওয়ার আকাঙ্ক্ষা প্রকাশ করেছেন।]
নির্জন রাতে নীরব প্রান্তরে
যদি তোমার আগমন হতো;
তবে তোমাকে কাছে পাওয়ার বেদনা
কতো মধুময় হতো!
এই স্তবকে কবি তার প্রিয়জনের জন্য তীব্র longing বা আকাঙ্ক্ষা প্রকাশ করেছেন। ‘তোমার আগমন’ বলতে প্রিয়জনের ফিরে আসার কথা বলা হয়েছে। কবি বলছেন, নির্জন রাতে প্রিয়জনের আগমনের জন্য যে কষ্ট, সেই অপেক্ষার বেদনাও মধুর মনে হতো। এখানে কষ্ট এবং মধুর অনুভূতির এক দারুণ মিশ্রণ তুলে ধরা হয়েছে।]
নিশী রাতের নীরবতা আর প্রকৃতির ছায়ায়
যদি তোমার শুভাগমন হতো;
তবে নিশি-জাগা রজনীর স্মৃতি
আজও আমার প্রাণে বয়ে যেতো।
[আগের স্তবকের মতোই এখানেও প্রিয়জনের জন্য অপেক্ষা ও স্মৃতিচারণ আছে। কবি কল্পনা করছেন, কোনো এক রাতে যদি প্রিয়জনের আগমন ঘটত, তাহলে সেই রাত জাগার স্মৃতিগুলো আজও তার মনে জীবন্ত থাকত। এই স্তবকটি স্মৃতিকে ধরে রাখার আকুলতা প্রকাশ করে।]
জীবনের সুর, সংগীতের রাগিণী যদি
অনুভূতির গতি হতো;
তবে ভালোবাসার অনুভূতিগুলো
ছন্দময় হতো।
[এই স্তবকে কবি জীবনের অনুভূতিগুলোকে সংগীতের সঙ্গে তুলনা করেছেন। তিনি মনে করেন, যদি জীবনের ছন্দ আর সুর অনুভূতির গতি হয়ে উঠত, তাহলে ভালোবাসার প্রতিটি অনুভূতিই এক একটি ছন্দময় কবিতা বা গানের মতো সুন্দর হতো। এটি জীবনের আবেগ আর ছন্দকে এক করে দেখার এক কাব্যিক রূপ।]
প্রবাসের সুদূরে আজও আমি
নীরবে ভাবি শত বিরহ-বেদনার
স্মরণীয় স্মৃতি কথা,
কালের ইতিহাসে জীবন পাতার গতি
চিরন্তন নিয়মে বয়ে রবে যুগ যুগান্তর।
[এটি কবিতার শেষ স্তবক এবং এখানে একটি চূড়ান্ত উপসংহার টানা হয়েছে। কবি নিজেকে প্রবাসে থাকা একজন মানুষ হিসেবে দেখিয়েছেন, যে তার অতীতের বিরহ ও বেদনার স্মৃতিগুলো নীরবে স্মরণ করছে। তিনি উপলব্ধি করছেন যে, জীবন এবং তার সব ঘটনা সময়ের স্রোতে চিরকাল ধরে বয়ে চলে। জীবনের পাতাগুলোতে লেখা স্মৃতিগুলো কালের ইতিহাসে অক্ষয় হয়ে থাকবে। এটি একধরনের দার্শনিক উপলব্ধি, যেখানে ব্যক্তি জীবনের ক্ষুদ্র দুঃখ-কষ্টকে সময়ের বিশাল প্রবাহের সঙ্গে মিলিয়ে দেখা হয়েছে।]
লেখক: এম. এ. গফফার
শেফিল্ড, ইংল্যান্ড
জন্মনিবাস: ঠাঁকুরভোগ, সুনামগঞ্জ।